শেরপুর প্রতিদিন ডট কম

Home সম্পাদকীয় ফাগুন চলে যাবার আট মাস : প্রতীক্ষা ন্যায়ের, ন্যায্যতার
ফাগুন চলে যাবার আট মাস : প্রতীক্ষা ন্যায়ের, ন্যায্যতার

ফাগুন চলে যাবার আট মাস : প্রতীক্ষা ন্যায়ের, ন্যায্যতার

কাকন রেজা : ফাগুন চলে গেছে আট মাস হয়ে গেলো। অনেকটাই দীর্ঘ সময়, অনেকে হয়তো ভুলে যেতেই বসেছেন। তাদের মনে করিয়ে দেয়ার জন্য মূলত এই লেখা নয়। এটা নিজের বুকের ভার কমানোর অযথা চেষ্টা বলতে পারেন। একজন ন্যায়বিচার বঞ্চিত পিতার আত্মকথন। জানি, আমি ছাড়াও বিচার বঞ্চিত আরো পিতা রয়েছেন। রয়েছেন মা, ভাই,বোন আর স্ত্রী। যারা প্রতিদিন জায়নামাজে বসে আল্লাহ’র কাছে বিচার সপে দিচ্ছেন। চোখের পানিতে ঝরছে তাদের জাগতিক ব্যর্থতার ফরিয়াদ।

ফাগুন, মানে ইহসান ইবনে রেজা, ফাগুন রেজা। একজন মেধাবী, সৎ ও প্রতিশ্রুতিশীল গণমাধ্যমকর্মী। যাকে আজ ‘পাস্ট টেন্সে’ লিখতে হয়। ফাগুন আজ অতীত। সমাজের কাছে রাষ্ট্রের কাছে। কিন্তু বাবার বুকে সে এখনো বর্তমান। খুন হওয়া সন্তানের ফরিয়াদি পিতার কাছে কোনো কিছুই অতীত হয় না। একজন গণমাধ্যমকর্মীকে গুপ্তঘাতকেরা গুম করার পর খুন করে ফেলে গেলো রেললাইনের ধারে, এমন দৃশ্য সয়ে নেয়া তারই গণমাধ্যমকর্মী পিতার কাছে কতটা সম্ভব? কার কাছে রাখি এমন প্রশ্ন! সমাজ ও রাষ্ট্র কি তৈরি এমন প্রশ্নের উত্তরে? হায়, প্রশ্নের পিঠে শুধু প্রশ্ন জমে!

আজ আট মাস ধরে প্রতিরাত জেগে আছি। জানি, ফাগুন ফিরে আসবে না। এ প্রতীক্ষা ফাগুনের ফিরে আসার নয়, অন্য ফাগুনদের বাঁচানোর। অপেক্ষা বিচারের। যাতে আর ফাগুনেরা ঝরে না পড়ে। যাতে দেশ না হারায় অমিত সম্ভাবনার উৎসগুলোকে। অথচ, প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। যে নাগরিক নিরাপত্তার সংকল্প নিয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি, সেই সংকল্প, চিন্তা ব্যর্থ হচ্ছে। ফাগুনের পরে আরো ফাগুন ঝরে গেছে, পড়ছে। ক্রমাগত রচিত হচ্ছে তারুণ্যের শোকগাথা।

আট মাস, অনেকের কাছেই দীর্ঘ সময়। কিন্তু পিতার কাছে কালকের কথা। কিংবা একটু আগের। এইতো ছিলো সে। তার বই পড়ে আছে, মোড়ানো পাতা। যেনো একটু পরেই এসে পড়বে বাকিটা। ইস্ত্রি করা শার্ট আলমিরায়, হ্যাঙ্গারে ঝোলানো প্যান্ট। এই তো বেরোবে সে। দৃপ্ত পা রাখবে রাজপথে, হাঁটবে আপন গন্তব্যে। বিশ্বাসে দৃঢ়, প্রত্যয়ে নির্ভয়, এমন ফাগুনেরা হারায় কি কখনো? পথরেখা রেখে যায়, অন্যরা যেনো সে পথে নামে। আমাদের ভেঙে পড়া সমাজ আর রাষ্ট্র চিন্তায় এমন বিশ্বাস আর প্রত্যয় বড় দরকার আজ।

ফাগুনের প্রোফাইল সংরক্ষিত করেছে ফেসুবক। আমি ঢুকি না, সাহস হয় না। ওর করা কিছু প্রশ্ন এবং উত্তর দেয়ার ব্যর্থতা নিজেকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ইদানিং ওর ছবির সামনে দাঁড়াতেও সাহস পাই না। ওর ঝকঝকে চোখের জিজ্ঞাসা আমাকে লজ্জিত করে। মাথা নিচু হয়ে যায় ব্যর্থতায়। অথচ যে ব্যর্থতার দায় সমাজের, রাষ্ট্রের। নির্লজ্জ সে সমাজ আর রাষ্ট্রের লজ্জা বয়ে চলি আমি, এক অসহায় পিতা। থাকি নতমুখে, কুন্ঠিত এক মানুষ, ‘ন-মানুষে’র ভীড়ে।

দুই.
অনেকে সান্ত্বনা দেন, সাগর-রুনির প্রসঙ্গে তুলে। আমার বিস্ময় আরো বাড়ে, কী অবলীলায় বলে যায় তারা সেই দম্পত্তির বিচারহীন হত্যাকান্ডের কথা! এ যে তাদেরই ব্যর্থতা, একবার কি ভেবে দেখেন তারা! কী আশ্চর্য অনুভূতিহীনতা! মেঘের সামনে দাঁড়াতে তাদের কেউ কি আমার মতন লজ্জিত হন না? সাগর-রুনি’র সন্তান যে মেঘ। মেঘ কি বয়ে চলে না আমার মতন সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতার লজ্জা? এই প্রশ্নই বা কাকে করি! যাদের উত্তর দেয়ার কথা, তারা তো হারিয়েছেন বিস্মরণে কিংবা স্মরণের আনুষ্ঠানিকতায়।

যারা উদাহরণ টানেন নির্বিকার, তাদের বলতে ইচ্ছে করে, ‘আপনার হারাক, তবেই বুঝবেন শূন্যতা কাকে বলে।’ একজন পিতার অস্তিত্ব থাকে সন্তানে। তাকে হারানো মানে নিজ অস্তিত্ব হারানোর শূন্যতা। অনেকটা নিজের মৃত্যুকে প্রতিক্ষণ নিজ জ্ঞানে দেখা। আবার সেই সন্তান, যে অমিত সম্ভাবনাময়। যার কাছে শুধু পিতা হিসাবে নয়, পিতার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়ার কথা ছিলো এ দেশের। বিদেশে যাওয়ার শত সুযোগ যে অবলীলায় পায়ে ঠেলেছে নিজ দেশে থাকার জন্য। অথচ সেই দেশই তাকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হলো। আহা, ফাগুন! হায়, দেশ!

তিন.
‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’, কথার এই ফর্মটি বহু চর্চিত। অথচ প্রায়োগিক কি? ফাগুনের চলে যাবার আট মাস কিংবা সাগর-রুনি’র এতটা বছর কি ‘ডিনাইড’ এর সত্যটাকে ধারণ করে না? যদি ধারণ না করতো সাগর-রুনি’র পর তরুণ ফাগুন নিহত হতেন না। যার ধারাবাহিকতা নানা ভাবে আজো চলমান।

গণমাধ্যমে যারা প্রবীণ, যাদের অভিভাবক ভাবেন অনেকে, তাদের নিষ্পৃহতার বীজ আজ বিষ বৃক্ষ হতে চলেছে। খোদ তারাও আক্রান্ত আজ। আজ তাদের বলি, আয়নার সামনে দাঁড়ান, সামনের অবয়বকে প্রশ্ন করুন, তুমিও কি দায়ী নও? দেখুন উত্তর কী আসে।

শেষ করি নিজেরই আরেকটি লেখার অংশ দিয়ে। নিজেদের জ্ঞাতিদের নিয়ে লেখা। যার শুরু মার্টিন নিম্যুলারের কবিতা থেকে নেয়া ‘দ্যায়ার ওয়াজ নো ওয়ান লেফ্ট টু স্পিক’ কথাটির আবহে। “প্রথমে গেলো বিরোধীমতের জন, কথা বলিনি। কারণ মতের ভিন্নতা ছিলো। পরে গেলো নিজমতের অন্যজন। কথা বলিনি, ব্যবসায়িক বিভেদ ছিলো বলে। এরপর নিজেদেরই আরেকজন। তবুও নিশ্চুপ। কারণ ঈর্ষা, তার পরিচিতি ছিলো বেশি। এখনতো আমি ছাড়া আর কেউ নেই!”


LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here