ময়মনসিংহের ভালুকার স্কয়ার মাস্টারবাড়ি এলাকায় এল এসকোয়্যার লিমিটেড পোশাক কারখানায় দুই দিনে ৯০ শ্রমিক অসুস্থ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) কারখানা বন্ধ রেখে শ্রমিকদের কাউন্সেলিং ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ভালুকা শিল্প-পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ারুল হক এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছি। সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রেখে শ্রমিকদের কাউন্সেলিং ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে শ্রমিকদের উপস্থিতি কম ছিল।
এর আগের দিন শনিবার সকালে কাজে যোগ দিতে এসে ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাদের কারখানার মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এছাড়া বৃহস্পতিবার কারখানাটির অন্তত ৭০ শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন।
চিকিৎসকরা গণমনস্তাত্ত্বিক রোগে শ্রমিকদের অসুস্থ হওয়ার কথা বলেছেন। জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি শনিবার থেকে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে পোশাক কারখানাটির নানা ত্রুটির বিষয়।
কারখানা সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ভালুকা উপজেলার স্কয়ার মাস্টারবাড়ি এলাকায় এল এসকোয়্যার লিমিটেড পোশাক কারখানায় অন্তত ৭০ জন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের অধিকাংশই নারী। সেদিন সকাল আটটার দিকে কাজে যোগ দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই শ্রমিকদের কারো মাথা ঘুরাচ্ছিল, কারও বমি বমি লাগছিল, কারও শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, অনেকের পূর্ণ চেতনা ছিল না। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে অসুস্থ শ্রমিকদের স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেদিন কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়।
শনিবার সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে ভেতরে গেলে অনেকে অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। তখন ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জানিয়েছেন ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলীনূর খান।
ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হাসানুল হোসেন বলেন, শ্রমিকদের অসুস্থ হওয়ার লক্ষণ দেখে ধারণা করা হচ্ছে তারা গণমনস্তাত্ত্বিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরইমধ্যে তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে।
কারখানার এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শনিবার সকালে কাজ করতে এলেও তাদের কাজ করতে দেওয়া হয়নি। কারখানায় প্রবেশের পর অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসার জন্য ভিড় করেন অনেকে। কারখানার ভেতরে মাইকিং করে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছিল। কাউকে কাজ করতে হবে না বলা হচ্ছিল। এছাড়া পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি খাওয়া, কারখানা থেকে যাওয়ার পর বিশ্রাম নেওয়া, মুঠোফোন বেশি না দেখা, অসুস্থবোধ করলে চিকিৎসাকেন্দ্রে যাওয়াসহ নানা করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছিল।
গত ৩১ আগস্ট কারখানায় কাজ করা অবস্থায় সাবিনা আক্তার (৩৭) নামের এক অপারেটর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পোশাক কারখানার মেডিকেল সেন্টার থেকে তার চিকিৎসা করা হয়।
কারখানাটির এক শ্রমিক বলেছেন, সেদিন সাবিনার বমি বমি লাগছিল, রক্তচাপের সমস্যা হচ্ছিল। তিনবার মেডিকেল সেন্টারে যাওয়ার পর তাকে ছুটি দেওয়া হয়। পরদিন রোববার বাসায় মারা যান সাবিনা।
ওই শ্রমিক জানান, সাবিনা আক্তারের বাড়ি সিলেটে। জুলাই মাসে অপারেটর পদে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন।
কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মো. মনির হোসেন বলেন, সাবিনা গত ৩১ আগস্ট অসুস্থ হওয়ার পরদিন মারা যান। কারখানায় কাজ করা শ্রমিকেরা অসুস্থ হন, এটি নিয়মিত ঘটনা। তবে সাবিনা কী কারণে মারা গেছেন, তা তিনি জানেন না। গত শুক্রবার মধ্যরাতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে একটি নির্দেশনা আসে। সে অনুযায়ী কোনো শ্রমিককে দিয়ে আজ কাজ করানো হচ্ছে না। তাদের বিভিন্নভাবে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে।
এদিকে কারখানায় কাজ করতে আসা শ্রমিক অসুস্থ হওয়ার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। শনিবার বেলা ১১টার দিকে কমিটির সদস্যরা কারখানায় গিয়ে কাজ শুরু করেন। এর আগে জেলা প্রশাসন ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিকে ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তদন্ত করে সুস্পষ্ট মতামতসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান ইউএনও আলীনূর খান বলেন, আজও ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক অসুস্থ হয়েছেন। তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার কারখানাটিতে শ্রমিক অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল কারখানায় পাঠায়। তারা প্রাথমিক তদন্তে কারখানার নানা ত্রুটি পেয়েছে।
ময়মনসিংহের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আহমাদ মাসুদ বলেন, আমাদের প্রাথমিক তদন্তে কারখানার অবকাঠামোগত ত্রুটি ও বায়ু চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকার বিষয়টি সামনে এসেছে। সেজন্য কারখানাটিতে চিঠি দিয়ে উপযুক্ত মানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এগজস্ট ফ্যান স্থাপনপূর্বক নিরাপদ ও শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এছাড়া অসুস্থ শ্রমিকদের কোম্পানির খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।
কারখানা কর্তৃপক্ষকে অধিদপ্তর থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে কারখানার ত্রুটিগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি সমস্যা সমাধানে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয় কর্তৃপক্ষকে। শ্রমিক অসুস্থ হওয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটলে শ্রম আইন অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয় চিঠিতে।