আমাদের শহর ও পরিবেশকে দুর্গন্ধমুক্ত রাখতে যারা সদা শ্রম দিয়ে যাচ্ছে শত শত বছর ধরে, তারা শুরু থেকেই আমাদের সমাজ থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সেই জাতী গোষ্ঠীরও নানা কষ্ট গ্লানি আর লাঞ্ছনার পাশাপাশি রয়েছে আনন্দ উল্লাস আর আচারাদি। তারা হচ্ছে সুইপার বা হরিজন সম্প্রদায়। সমাজের নানা নিষ্পেশনে তাদের কৃষ্টিকালচার প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান চলে সেই রীতিনীতি ও কৃষ্টিকালচারে। সমাজের অনেকেই এখন তাদের সেই কৃষ্টিকালচারে সরিক থেকে উৎসাহিত করে যাচ্ছে।
জানা গেছে, প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো শেরপুর পৌরসভার পরিচ্ছন্নকর্মীর প্রয়োজনে তৎকালীন জমিদাররা অবিভক্ত ভারতের ইলাহিবাদ থেকে একদল সুইপার বা হরিজনকে নিয়ে আসেন। সেই থেকে শুরু শেরপুর হরিজন পল্লীর যাত্রা। হরিজনরা মূলত হিন্দি ভাষাভাষির সনাতনি ধর্মে বিশ্বাসি। তারপরও তাদের রয়েছে নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার। বিশেষ করে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো হয় ৭ দিনব্যাপী নানা উপাচার ও রীতিনীতি।
বিয়ে উপলক্ষে সাজানো হয় অন্যসব বিয়ে বাড়ির মতোই। পল্লীর সামনে আলোকসজ্জায় সাজানো হয় গেইট। পল্লীর ভেতর উঠোন সাজানো হয় রঙে আঁকা ফুল, লতা-পাতার বিন্যাসে। বিয়ে উপলক্ষে ঘরের মেঝেতে আঁকা হয় আল্পনা। ছোট্ট উঠানেই চলে বিয়ের আয়োজন।
তাদের রীতি অনুযায়ী বিয়ের শুরুটা হয় সাজানো মন্ডপ থেকে। বাড়ি কর্ত্রী বা বড় বউ আচারাদি শুরু করেন। এসময় নানা উপকরণে ডালা সাজিয়ে প্রদীপ ও ধুপ জ্বেলে বাড়ির সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী খাঁচা নিয়ে যাওয়া হয় নিকটস্থ পুকুর পাড়ে। সেখান থেকে খাঁচা ভরে মাটি এনে মন্ডপের ভিতর টবে ভরে ঘট তৈরি করা হয়। এ মাটি আনতেও পুকুর পারের নানা নিয়ম ও পূজা অর্চনা করা হয়। এরপর অশুভ শক্তিকে বদ করে আচারাদির কাজ শেষ করা হয়। এসময় হরিজন নারীরা তাদের চিরচারিত প্রায় হারিয়ে যাওয়া বিয়ের গীত পরিবেশন করেন। এরপর নারায়ণ পূজা, আর্শিবাদ, শুদ্ধি বিয়ে, হায়ে হলুদসহ আরো কত কী। এসময় পল্লীর নারী ও শিশুরা উৎসবে নাচগানে মেতে উঠে। গত ১৪ মার্চ বিয়ের কাজ শেষ হয়েছে শেরপুরের বিনত হরিজন এবং ঢাকার সুত্রাপুরের স্মৃতি হরিজনের সঙ্গে।
এ বিয়ের বিষয়ে হরিজন পল্লীর নেত্রী মুক্তা হরিজন বলেন, হরিজনদের সপ্তাহব্যাপী বিয়ে। নানা উপাচারে নানা রীতিনীতি মেনেই বিয়ে। ধাপে ধাপে বিয়ে। ১৪ মার্চ ছিল বৌভাতের মাধ্যমে সমাপনী রাত। ধরে রেখেছে দেশাচার কুলচার আর বিশ্বাসের প্রত্যয়। এর আগে ছেলে এবং কনের বাড়িতে আলাদা সব আচারাদির কাজ সম্পন্ন করা হয়।
এ বিয়ের পৌরোহিত্য করেন চন্দন তেওয়ারি। অবাঙালি তেওয়ারি বাংলার জল মাটির ছোঁয়ায় আজকে তারা বাংলাভাষী। হরিজনদের পুরহিত। চন্দর তেওয়ারি মন্ত্র উচ্চারণ বৈবাহিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করেন দেশাওয়ালি বিয়ের অনুশাসন মেনে।
তবে মূল বিয়ের আগে একটি পর্ব আছে “শুদ্ধিবিয়ে”। যে বা যারা সামাজের অনুমতি না নিয়ে পালিয়ে গিয়ে কোর্ট ম্যারেজ বা কোন মন্দিরে নিজেরা নিজেরা মালা বদল করে যৌথ যাপন শুরু করেছেন। সেই জুটিদের সামাজের দশ জনের উপস্থিতিতে আবারও বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। সজিব হরিজন ও শিল্পা হরিজন আর পল্লব হরিজন ও নিশা হরিজন এই দুই জুটি ৫/৬ বছর পর শুদ্ধি বিয়ে হলো নারায়ণী পুজা সম্পাদনের ভেতর দিয়ে। এর আগে ওরা ছিল অপবিত্র। সামাজিক নানা কুলাচারে অংশ নিতে পারেনি। পুকুর ঘাটের মাটি দিয়ে নির্মিত ঘট পটের মন্ত্রপুতজল ছটিয়েই তবে কুলে ওঠা, সমাজে ওঠা। সমাজের সাথে নতুন করে সংযুক্ত হওয়া। নতুন বিয়ের মতোই তাদের বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে বিয়ের কার্যাদি শেষ করা হয়। নতুন বিয়ের মতো বাড়ির সামনে গেইট দিয়েই প্রবেশ করতে হয়। এর পর বিয়ের পীড়িতে বসে বিয়ের কার্য সম্পাদন। তাই তারা তাদের বিয়েকে বলেন সুদ্ধি বিয়ে।
এদিকে সমাজের সবচেয়ে নিগৃহিত ও পিছিয়ে পড়া হরিজনদের সমাজের কিছু মানুষ তাদেরকে যাপিত জীবনের মূলধারায় ফিরিয়ে আসতে সহযোগিতা করছেন। সমাজ থেকে ছিটকে পড়া হরিজনদের নানা আয়োজনে বিশেষ করে ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসেন শেরপুরের বিশিষ্টজন অনেকেই। হরিজনদের প্রায় হারিয়ে যাওয়া রীতি অনুযায়ী বিয়ের ক্রিয়াকলাপ দেখে তারাও মুগ্ধ।
এ বিষয়ে লেখক ও আলোচক জ্যোতি পোদ্দার বলেন, সমাজের হরিজনরা নিগৃহীত ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু তাদেরও আলাদা কৃষ্টি-কালচার ও জীবন ব্যবস্থা আছে । গত সাত দিনব্যাপী তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা তা দেখেছি। এতো নিপীড়িত নিগৃহীতার মধ্যেও তারা তাদের কৃষ্টিকে ধরে রেখেছে।
নাগরিক প্ল্যাটফর্ম জনউদ্যোগ এর আহবায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষেরা পিছিয়ে পড়া মানুষদের মধ্যেও পিছিয়ে পড়া। বিশেষ করে সমাজে অপান্তীয় এরা এবং মর্যাদাহীন ভাবে জীবন যাপন করে। বর্তমানে সমাজের পরিবর্তন আসছে, হরিজনরাও শিক্ষা দীক্ষা ও কর্মে এগিয়ে যাচ্ছে এবং মূল স্রোতের সাথে এরা মেশা ও চলার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
বিয়েতে আমন্ত্রিত হয়ে আসা শেরপুর মডেল গাল্স ডিগ্রী কলেজ এর অধ্যক্ষ তপন সারোয়ার বলেন, এক সময় সমাজের নিগৃহীত পরিজনদের আচার-আচরণ ও কৃষ্টি-কালচারে সমাজের মানুষ সম্পৃক্ত হতো না। তবে বর্তমানে বিশ্বায়নের কারণে তাঁদের পরিবর্তন আসছে। তারাও এখন সমাজের মূল স্রোতের সাথে মিশতে পারছে। বিশেষ করে তাদের ৭ দিন ব্যাপী কৃষ্টি কালচারের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত বিয়ের অনুষ্ঠানে সমাজের অনেক মানুষের সম্পৃক্ততায় তা প্রমাণ করে।
পল্লীর বয়োবৃদ্ধ ফুলতি হরিজন বলেন, শেরপুরে তাদের আদি গোষ্ঠীর মানুষ বৃট্রিশ শাসনামলে শেরপুরে আসলেও তখন থেকেই তারা তাদের রীতি অনুযায়ী বিয়ে দিয়ে আসছেন।
এদিকে শহর ও সমাজকে ময়লা-দুর্গন্ধ থেকে মুক্ত রাখতে যারা শত শত বছর জুড়ে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে তারা একপেশে ও সমাজের নিগৃহিত জাতীগোষ্ঠীরা তাদের কৃষ্টিকালচার নিয়ে বেঁচে থাকুক যুগযুগ এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয় সচেতন মহলের।