শেরপুর প্রতিদিন ডট কম

Home জাতীয় শান্তি চুক্তির ২৬ বছর, পাহাড়ি জনপদে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন
শান্তি চুক্তির ২৬ বছর, পাহাড়ি জনপদে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন

শান্তি চুক্তির ২৬ বছর, পাহাড়ি জনপদে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন

আজ ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি। দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শেষে ১৯৯৭ সালের এইদিনে সরকারের কাছে সন্তু লারমা’র নেতৃত্বে অস্ত্র সমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। শুরু হয় পাহাড়ে ব্যাপক আকারে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। রাঙামাটিতে স্থবিরতা কাটিয়ে ফিরে আসে কর্মচাঞ্চল্য, সচল হয় অর্থনৈতিক চাকা, বাড়ে উন্নয়ন যজ্ঞ।
১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে হানাহানিতে অর্থনীতিতে তেমন একটা উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল না প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর রাঙামাটির। সুবিশাল হ্রদকে কাজে লাগিয়ে মৎস্য উৎপাদন, পর্যটন ও বনজ সম্পদ আহরণের যে পরিকল্পনা তা কাজে আসেনি পাহাড়ের অস্থিতিশীল পরিবেশের জন্য। কিন্তু এক চুক্তিতেই আমূল পরিবর্তন এসেছে রাঙামাটির অর্থনীতিতে। উন্নয়ন হয়েছে জেলার স্বাস্থ্যখাত থেকে শুরু করে শিক্ষা, পর্যটনসহ নানান ক্ষেত্রে। স্থাপিত হয়েছে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। পাহাড়ের আনাচে-কানাচে তৈরি হয়েছে রিসোর্ট-কটেজসহ পর্যটকবান্ধব অনেক স্থাপনা। একসময়ের অশান্ত ও রক্তাক্ত সুবজ পাহাড়ে আজ দৃশ্যমান পরিবর্তন।
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অপু ইসলাম বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তি হওয়ার পর দেশের অন্যান্য যে শহরগুলো আছে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাহাড়েও অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। আগে এখানকার শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য রাঙামাটির বাইরে যেতে হত, কিন্তু এখন নিজ জেলায় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়াতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘব হয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসা, পর্যটন, কৃষিসহ নানান ক্ষেত্রের উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। পার্বত্য শান্তিচুক্তির ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে।
রাঙামাটির বরকল উপজেলার বাসিন্দা আদনান সাকিব বলেন, বরকলে একসময় আমরা লঞ্চ বা ইঞ্চিনচালিত নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতাম। গ্রীষ্ম মৌসুমে লেকে পানি না থাকলে আমাদের উপজেলায় যেতে, পণ্য পরিবহন বা রোগী আনা নেওয়ায় আমাদের কখনো কখনো ৮/৯ ঘণ্টা সময় লেগে যেত। কিন্তু বর্তমানে বরকলে সীমান্ত সড়কের কাজ চলমান রয়েছে। সীমান্ত সড়ক হয়ে গেলে আমাদের যাতায়তে আর কোনো কষ্ট থাকবে না।
চুক্তি পরবর্তী সময়ে শান্তি বাহিনীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পর পাহাড়ের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানান উদ্যোগের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান। পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিদ্যুৎ সম্প্রসারণ ও নিরাপত্তা শঙ্কা দূর হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও গতি আসে।
রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের রাঙামাটি সড়ক বিভাগে অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়েছে। তার মধ্যে আমাদের ৪টি সড়ক নির্মাণে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। এছাড়া নানিয়ারচর উপজেলায় চেঙ্গী নদীর ওপরে ৫০০ মিটার সেতুসহ ৩টি সেতু নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে আরও ৭টি সেতু নির্মাণাধীন রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রায় ১৩০ কিলোমিটার সীমান্ত সড়কের কাজ চলমান রয়েছে।
চুক্তির পর পাহাড়ের কোণায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে নামে সরকার ও সাধারণ মানুষ। পাহাড় ও হ্রদের সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে পর্যটন সম্ভাবনা বেড়ে যায়। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা না থাকায় দেশ-বিদেশের পর্যটকরা রাঙামাটি ভ্রমণ করতে পারছেন। সীমান্ত সড়কের মাধ্যমে দুর্গমতা কমে আসছে। ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তাই পাহাড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে বাগান, পশু পালন, মৎস্য শিকারের মাধ্যমে মানুষে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক তপন কুমার পাল বলেন, ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি হওয়ার পরে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম অত্র রাঙামাটি জেলায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় এখানে আম, লিচু, মাল্টা, কুল, ড্রাগন, লেবু জাতীয় বাগানসহ বিভিন্ন ফল-ফলাদির বাগানের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি শান্তি চুক্তির ফলে যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে তাই কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে। কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীরাও নির্বিঘ্নে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করছে। এতে পাহাড়ের কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যা দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
পাহাড়ে উন্নয়ন যজ্ঞ চলছে বলে দাবি করে স্থানীয় সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে ১০০টি সেতু উদ্বোধন করেছেন। যার মধ্যে ৪৪টি সেতুই পার্বত্য চট্টগ্রামে। স্কুল, কলেজগুলো জাতীয়করণ করা হয়েছে। মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাইলের পর মাইল রাস্তা হয়েছে, বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। প্রত্যেকটি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে ১০ শয্য থেকে ৫০ শয্য পর্যন্ত উন্নত করা হয়েছে। শান্তি চুক্তির ফলেই পাহাড়ের এই উন্নয়ন।
দেশের সমতলের অঞ্চলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাঙামাটির অর্থনৈতিক অবস্থা আরও এগিয়ে যাবে তেমনটাই প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।


LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

fourteen + 20 =