শেরপুর প্রতিদিন ডট কম

Home সারাদেশ ফেনীতে ৯ মাসে ৭৫ জনের আত্মহত্যা
ফেনীতে ৯ মাসে ৭৫ জনের আত্মহত্যা

ফেনীতে ৯ মাসে ৭৫ জনের আত্মহত্যা

ফেনী সদর উপজেলার শর্শদী ইউনিয়নের আবুপুর গ্রামের হুমায়ুন কবীরের ছেলে আবদুল্লাহ আল নোমান (২২)। পেশাগত জীবনে ফটোগ্রাফিকে বেছে নিয়ে ফেনী শহরের উত্তর ডাক্তার পাড়ায় একটি বাসায় বসবাস শুরু করেছিলেন। চলতি বছরের ১৭ মে এ তরুণের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

নোমানের স্বজনরা জানান, বেশ কিছুদিন ধরে নোমান ফেসবুকে তার বিভিন্ন কষ্টের কথা জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে আসছিলেন। এসব স্ট্যাটাসে তিনি প্রেমের সম্পর্ক বিচ্ছেদ ও পারিবারিক কলহের বিষয়টি ইঙ্গিত দিতেন। এর আগেও তিনি একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে প্রায় তিনদিন অচেতন ছিলেন বলেও দাবি করে তার বন্ধু-স্বজনরা।

এভাবেই ফেনীতে বেড়েই চলছে আত্মহত্যার প্রবণতা। পুলিশ ও বিভিন্ন তথ্য পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, জেলায় আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ পারিবারিক কলহ। এছাড়া বিভিন্ন অপ্রাপ্তি ও মানসিক সমস্যা থেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে এ পথ বেছে নিচ্ছেন অনেকে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে দাগনভূঞায়। এ উপজেলায় চলতি বছর ২০ জন আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া ফেনী সদর উপজেলায় ১৯ জন, সোনাগাজীতে ১৩ জন, ফুলগাজীতে ১০ জন, ছাগলনাইয়ায় ৭ জন এবং পরশুরামে ৬ জন রয়েছে। তাদের অধিকাংশ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

আত্মহত্যার হার উদ্বেগজনক হলেও প্রায় ১৬ লাখের বেশি মানুষের ফেনীর এ জনপদে নেই কাঙ্ক্ষিত মানসিক চিকিৎসা সেবা। শহরে বেসরকারি উদ্যোগে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মানসিক চিকিৎসা সেবা দিলেও নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ। ফেনী স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারিভাবে ফেনীতে মানসিক চিকিৎসায় কোনো পোস্টিং নেই।

গত ২ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী পৌরসভার পূর্ব চরগনেশ রেজি মিয়াজী বাড়িতে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে রোকশানা আক্তার আকলিমা (১৪) নামে এক কিশোরীর আত্মহত্যা করে। সে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসায় ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।

নিহতের স্বজনরা জানান, পরিবারে আকলিমা কিছুদিন ধরে অস্বাভাবিক আচরণ করছিল। প্রায় সময় একা থাকত। ওইদিন তেমন কোন ঝামেলা ছাড়াই সামান্য কিছু কথায় অভিমান করে সে আত্মহত্যা করে। আশপাশে মানসিক রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকা এবং সামাজিক বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চাইলেও কোনো চিকিৎসা করাতে পারেননি বলে জানায় তার পরিবার।

জেলায় মানসিক চিকিৎসায় নিয়োজিত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ফেনী সাইকিয়াট্রি হসপিটালের চেয়ারম্যান ডা. তবারক উল্ল্যা চৌধুরী বায়েজীদ বলেন, ফেনীতে মানসিক রোগের চিকিৎসা অপ্রতুলতা এবং যোগ্যতাসম্পন্ন জনশক্তির অভাব চরমে। জেলায় মানসিক রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ১০ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় আসছে। আবার ২০ শতাংশের বেশি যেখানে যাচ্ছে সেখানে উপযুক্ত সেবা পাচ্ছে না। এছাড়া মানসিক রোগ নিয়ে এখনও সামাজিক কুসংস্কার, অনীহা এবং অজ্ঞতা রয়েছে।

মানসিক চিকিৎসায় প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, সাপ্তাহিক যে চিকিৎসকরা ফেনীতে এসে সেবা দিচ্ছেন তারা মূলত মানসিক ভারসাম্যহীন বা তার কাছাকাছি অবস্থার রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। বৃহৎ জনগোষ্ঠী ছোট ছোট যে বিষয়গুলোর জন্য প্রতিনিয়ত মানসিক সমস্যায় ভোগে সেগুলোর জন্য কোনো জনবল বা সচেতনতা কোনোটাই নেই। এজন্য সরকারি উদ্যোগে প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রমের বিকল্প নেই।

জেলায় মানসিক রোগের উল্লেখযোগ্য কারণ উল্লেখ করে ডা. তবারক উল্ল্যা চৌধুরী বায়েজীদ বলেন, ফেনী একটি প্রবাসী অধ্যুষিত জনপদ। এখানের প্রবাসীদের পরিবারের স্ত্রী বা অন্য সদস্যরা বিভিন্ন দিক দিয়ে অনেক বেশি হতাশায় ভোগেন। যা সামাজিকভাবে অন্যতম একটি কারণ। সবচেয়ে বড় কথা এটি এখনও তেমন চোখেও লাগে না।

নিজ প্রতিষ্ঠানে সেবার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ফেনী সাইকিয়াট্রি হসপিটালে প্রতি  মাসে গড়ে ৫শ থেকে ৬শ রোগী মানসিক চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। এছাড়া নিয়মিত ১০ শয্যায় আবাসিকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে।

মানসিক রোগের সেবাগ্রহীতা ফিরোজা বেগম (২৭) নামের এক রোগীর অভিভাবক বলেন, এটি যে একটি রোগ তা শুরুতে পরিবারের সদস্যদের বোঝাতেই কষ্ট করতে হয়েছে। এছাড়া সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তো আছেই।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জাকারিয়া সিদ্দিকী বলেন, ফেনীর মানসিক রোগে আক্রান্ত সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে বেশিরভাগ কারণ প্রবাসী স্বামী, পারিবারিক কলহ, হতাশা, বেকারত্ব ও নানা অপ্রাপ্তি। সেবাগ্রহীতাদের উল্লেখযোগ্য অংশ দেরি করেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। এক্ষেত্রে গ্রামীণ জনপদে আরও সচেতনতা প্রয়োজন।

এদিকে জেলার মানসিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সমস্যা উত্তরণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান বিশিষ্টজনরা।

অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে ডা. তবারক উল্যা চৌধুরী বায়েজীদ বলেন, অভিভাবক চাইলেও পর্যাপ্ত মনোবিদ না থাকায় আক্রান্ত রোগীকে কাউন্সিলিং করাতে পারেন না। জেলায় ৮ থেকে ১০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিভিন্ন ক্লিনিকে সপ্তাহের বিভিন্ন দিন সেবা দেন। যা এ জনপদের জন্য অপ্রতুল।


LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

18 + seventeen =